শুক্রবার, ৯ ডিসেম্বর, ২০১৬

আমি টেকনাফ সীমান্ত থেকে বলছি
মু.আতাউর রহমান:

টেকনাফ সীমান্ত চৌকির একজন বিজিবি সদস্যের(নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) বক্তব্য দিয়েই শুরু করছি। তার প্রতি আমার সংবাদকর্মী সুলভ প্রশ্ন, কেমন চলছে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকানো অভিযান? আমার প্রশ্নের কারন সরাষ্ট্রমন্ত্রী মিডিয়ায় বললেন, মানবিক কারনে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়া হচ্ছে। জাতিসংঘ মুখপাত্র বললেন, ১০হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রিত হয়েছে। আর সাথে সাথে কোটি কোটি টাকার ত্রানের ঘোষনা আসতে থাকল বিভিন্ন সংস্থা থেকে।

বিজিবি সদস্য আপ্লুত কন্ঠে যা বললেন তা এরুপ: চোট্ট অবুঝ শিশু পায়ে (বিজিবির) গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদছে আর বলছে, আব্বু/চাচা আমাদের ওপারে ঠেলে দিবেন না! ওরা আমার বাবা কে জবাই করেছে! আমার মা কে বিবস্ত্র করে জলন্ত অগ্নিতে জ্বালিয়েছে! আমার প্রতিবেশীদের কাউকে কেটে টুকরো টুকরো করেছে! কাউকে আগুনে জ্বালিয়েছে!  অসংখ্য নারীদের বিবস্ত্র করে ইজ্জত লুটে জ্বলন্ত অগ্নিতে নিক্ষেপ করেছে! আমাদের খাদ্য, বস্ত্র কিছুর প্রয়োজন নেই, শুধু একটু বাঁচতে চাই। একটু বাঁচার আশায় এসেছি। দয়া করে আমাদের কে বাঁচতে দিন। আমাদের মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিবেন না। (এ পর্যায়ে বাচ্চার সাথে বিজিবিও কাঁদছে)

কাঁদছে বিজিবি, কাঁদছে মানবতা, কাঁদছে মুসলিম জনতা। কিন্তু ঐ বিজিবি যে হুকুমের গোলাম। তার হাত তো শিকলে বাঁধা। তবুও তিনি সরাষ্ট্রমন্ত্রীর মিডিয়ার ঐ বক্তব্যকে কৌশলী মনে করে গোলামীর চাইতে মানবতা কে প্রাধান্য দিয়ে ঐ শিশুসহ তার বহর কে টেকনাফ সীমান্তে আশ্রয়ের সুযোগ করে দিলেন। এভাবে হয়ত কিছু মানবতাবাধী বিজিবির মাধ্যমে ১০ হাজার রোহিঙ্গা আশ্রিত হয়েছে।

আসুন এবার একটু বিজিবি প্রসঙ্গের বাইরে আসি। আমি কিছুদিন আগে “রোহিঙ্গাদের শুধু বাংলাদেশে আশ্রয় দেয়াই সমাধান নয়” শিরোনামে একটা লেখা দিয়েছিলাম। এখনো তাই বলছি, তবে বাংলাদেশের মানুষ ঐতিহাসিকভাবে অথিতিপরায়ন এবং নির্যাতিতের পাশে ছিল। এখনো আশা করি তাই আছে। আমার ধারনা বঙ্গবন্ধু কিংবা জিয়া যে কেউ বেঁচে থাকলে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতেন নিশ্চিত। কিন্তু এ পর্যায়ে, সরকারের যে কৌশলী অবস্থান, টেকনাফ সীমান্তের কর্তব্যরতদের অনুধাবন করতে পারলেই হল। এখন আপাত দৃষ্টিতে যা বুঝা যাচ্ছে তাতে মনে হয়,সরকার সাপও মারতে চায়, লাঠিও ভাল রাখতে চায়।

টেকনাফ সীমান্তের এক পত্যক্ষদর্শীর বরাতে জানতে পারলাম, রোহিঙ্গা রা বিজিপি-বিজিবি উভয়ের কাছে উপেক্ষিত হয়ে হতভাগা ‘নাফ নদী’র বুকে আশ্রিত হল। ‘নাফ’ ও অবলা চোখে মনুষত্বহীনদের বৃদ্ধাআঙ্গুলী দেখিয়ে আশ্রয় দিল। কিন্তু নরপশু বিজিপি’র তাও সহ্যে হলো না।সীমান্ত থেকে গুলির আঘাতে অর্ধ-শতাদিক ভাসমান মানুষ হত্যা করে নাফ’র পানির রং রক্তে লাল করে দিল।
নাফ ও হায়েনাদের থাবায় বিক্ষত হয়ে হয়ত নির্যাতিতদের মত স্রষ্টার দিকে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকল। এদিকে এ ইস্যুতে টেকনাফ সীমান্তের ওপারের লেডী হিটলার সুচি’র বক্তব্য আমার কাছে বেশ চমকপ্রদ মনে হল। তিনি জানালেন, আরাকান সম্পূর্ন শান্ত! যা দেখানো হচ্ছে সব মিড়িয়ার কারসাজি! তিনি এও বললেন, আরাকানে রাখাইন ও রোহিঙ্গা উভয় জনগোষ্টির সমতার কথা, ওখানে নাকি বৌদ্ধ রাখাইনদের জনসংখ্যার বীপরিতে মুসলিম রোহিঙ্গাদের আধিক্য! তার কথা অনুযায়ী সংখ্যালঘুদের সংখ্যাগুরু নিধন চলছে! আমি তার এ বক্তব্যে চমকৃত যা না হয়েছি, তার চেয়ে বেশী আহ্লাদিত হচ্ছি তাকে সাহিত্যে একটা নোবেল দেয়ার জন্য; তার এমন সাহিত্য মিশালী বক্তব্যের জন্য।

সুচি’র কথিত আরাকানের শান্ত পরিস্থিতিতে যখন টেকনাফ সীমান্তের এপারে ‘নাফ নদী’তে শিশুর গলিত লাশ ভাসতে থাকে তখন ‘নাফ নদী’র মাছ গুলোও ঝপতে থাকে আমরা রোহিঙ্গা না হয়ে মৎসজাতী হয়েছি এটাই বোধহয় আমাদের সৌভাগ্য! কারন নাফ’র তীরে নিহতদের একমাত্র প্রতক্ষদর্শী সাক্ষী যে ঐ মাছগুলো। এমন এক
শ্বে আমরা বাস করছি যেখানে অন্যায়ভাবে মৎস নিধন করলে তারও শাস্তি হয়। কিন্তু রোহিঙ্গা, কাস্মীরি আর ফিলিস্তিনি হত্যা করলে তার জন্য শুধুই শান্তির বিবৃতি দেয়া হয়! ইতিহাস বলে, বাংলাভাষার আদি নিদর্শন ‘চর্যাপদ’ আবিস্কৃত হয় এই আরাকানেরই মুসলিম রাজদরবার থেকে। আর আমরা ঐ ভাষারই জীবন দিয়ে কিনে নেয়া ধারক হিসেবে গর্ভবোধ করি। কিন্তু আরাকানিদের জন্য একটি বিবৃতির বাইরে কিছুই করতে পারি না!
কারন আমরা আবার বিবৃতির লিমিট ক্রস করলে যে জবাবদিহির খড়কে পড়তে হবে প্রভুদের কাছে। মালয়েশিয়ার জনগনের কাতারে প্রধানমন্ত্রী দাড়িয়ে এটাই প্রমান করলেন আমাদের বিবৃতির বাইরেও আরো কিছু করার আছে। মালায়শিয়ার মত অন্তত ১৫টি মুসলিম রাষ্ট্রও ভূমিকা রাখতে পারত তাহলে রোহিঙ্গাদের লেডী হিটলার থেকে কিছুটা হলেও মুক্তি দেয়া যেত।

টেকনাফ সীমান্তের ওপারে প্রায় ৫০বছর ধরে চলে আসা রোহিঙ্গা মুসলমানের বিরুদ্ধে জাতিগত শুদ্ধি অভিযান (ethnic cleansing) এর সমাপ্তি যে কোথায় গিয়ে হবে একমাত্র আল্লাহই ভাল জানেন। মুসলিম বিশ্বের ক্রমবর্ধমান ব্যার্থ্যতা, নির্জীব OIC, পক্ষপাথী আন্তর্জাতিক মহল (internationl community) এভাবে যখন চলছে তাহলে খুব সহজে ধারনা করা যায় রোহিঙ্গা সহ বিশ্ব মুসলিম নিধন অভিযান অদৌ বন্ধ হবে না। যেখানে প্রায় ১২০০বছরের আদি বাসিন্দা রোহিঙ্গাদের এই পরিস্থিতি সেখানে আমি অন্য আরো কিছু মুসলিম রাষ্ট্র নিয়েও শংকিত। হয়ত পালাক্রমে এখন নিরবতা পালনকারীরাও রেহায় পাবেন না। আমি আগেও বলেছি এখনো বলছি এ মুহুর্তে মালয়েশিয়া যে ভূমিকা নিয়েছে আরো কিছু রাষ্ট্র যদি তাদের মত ভূমিকা নিতে পারে তাহলে নির্যাতিতদের ভাগ্যেন্নোয়নে কিছুটা আশাবাদি হওয়া যেতে পারে। সবমিলে সমগ্র মুসলিম দুনিয়া কে এক প্লাটফর্মে নিয়ে আসা এখন সময়ের শ্রেষ্ঠ দাবি।

লেখক:সংবাদকর্মী।

(প্রকাশিত লেখাটি লেখকের ব্যক্তিগত মতামত এবং লেখা সম্পর্কিত তথ্য ও বর্ণনার জন্য লেখকই দায়ী)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন